১.ভূমিকা -
বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের গুরুত্বকে কোন ভাবে অস্বীকার করা যায় না। সমগ্র মানব সভ্যতার রূপান্তরের কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান নিজেই নিজের বিকাশ সাধন করে চলেছে। মানব সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে সূচনাটা যদিও শান্ত ও ধীরগতিসম্পন্ন ছিল,কিন্তু মানুষের অগ্রগতি ঘটেছে খুব দ্রুত গতিতে। সর্বসমক্ষে মানুষের জানা-বোঝার সীমার মধ্যেই বছরে বছরে যেভাবে সেই গতি ত্বরান্বিত হয়েছে তার ফলশ্রুতিতে ঘটেছে বিজ্ঞানের কাঠামোর তার ভান্ডারে বিপুল পরিবর্তন। বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের জীবনধারাকে মূল্য পাল্টে দিয়েছে।
২.বিজ্ঞানের অর্থ ও সংজ্ঞা -
২.১.বিজ্ঞানের অর্থ-
ইংরেজি 'Science' কথাটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ 'Scientia' থেকে যার অর্থ জ্ঞান। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান কথাটি অর্থ হল বিশেষ জ্ঞান। বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস যতদূর অনুসন্ধান করা হয়েছে তাতে দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ বছর পূর্বে ও বিজ্ঞান চর্চায় যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এই বিষয়টি দুটি পরস্পর সম্পর্কিত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়েছে,বিজ্ঞান চর্চা পদ্ধতিতে এবং বিজ্ঞান চর্চা বিষয়ে এই দুটি দিক থেকে বিচার করে দেখা গেছে যে প্রাকৃতিক প্রকৃত বৈজ্ঞানিক সত্তা এবং পদ্ধতি ইতিহাস অতি ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত।
২.২.বিজ্ঞানের সংজ্ঞা -
বিজ্ঞান বলতে আমরা বিশেষ কোনো বিষয়কে বুঝি না। বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে সংগ্রহীত নানান জ্ঞানের সমষ্টির এবং তার অতিরিক্ত কিছু ,সেই কারণে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনেক তার কোনটি খুব তা স্পষ্ট।
বিজ্ঞানের একটি সহজ সংজ্ঞা হল -
"পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে ভৌত ও প্রাকৃতিক জগতের গঠন ও আচরণকে নিয়ে সুশৃংখল চর্চার উদ্দেশ্যে বৌদ্ধিক ও ব্যবহারিক কার্যকলাপ তাই বিজ্ঞান।"
James B Conant এর মতে -
"Science is an interconnected series of concepts and conceptual schemes that have developed as a result of experimentation and observation and are fruitful of further exper indentation and observation."
G.Gore এর মতে -
"Science is the interpretation of nature and man is the interpreter."
Norman Campbell এর মতে -
"Science is the study of those judgements concerning which universal agreement can be obtained."
অর্থাৎ বিজ্ঞান হল একটি সংঘবদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার যার একটি অনুসন্ধান পদ্ধতি ও অনুসন্ধানে একটি উপায় আছে এবং জীবনের প্রতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি ও একটি চিন্তণের উপায় রাখে।
৪.উদ্দেশ্যাবলী -
এই অধ্যায়টির পাঠ শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের নিন্ম লিখিত উদ্দেশ্য গুলি অর্জন করতে পারবেন।যথা-
১.বিজ্ঞানের অর্থ উপলব্ধি করতে পারবেন।
২.বিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন।
৩.বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।
৪.বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সংজ্ঞা ও পর্দা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারবেন।
৫.পাঠক্রমে পাঠ্যসূচী এবং পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কিত ধারণা লাভ করতে পারবেন।
৬.স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারবেন।
৭.বিদ্যালয় পাঠক্রমে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের স্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন
৫.বিজ্ঞানের প্রকৃতি -
বিজ্ঞানের সংজ্ঞা গুলি থেকে বিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।সেগুলি হল-
- সুশৃঙ্খলা চর্চা - বিজ্ঞান চর্চায় সুুুুশৃঙ্খল পরিকল্পিত পন্থায় অগ্রসর হয় এবং সেই কারণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যথেষ্ট যুক্তিভিত্তিক এবং নির্ভরযোগ্য। তার কারন কোন তথ্য তখনই জ্ঞানে রূপান্তরিত হয় যখন তা যুক্তি ও প্রমাণের জন্য অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।ব্যক্তিগত উপলব্ধি,ধারণা,অনুমান ইত্যাদি যদি প্রমাণ না হয় তবে তা কখনোই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের হিসেবে স্বীকৃতি হয় না।এইজন্য বিজ্ঞান ব্যক্তি নিরপেক্ষ সুশৃঙ্খল জ্ঞানচর্চা।
- প্রকৃতি ও ভৌত জগৎ - বিজ্ঞান চর্চায় বিষয় ভৌত ও প্রকৃতি জগৎ । সুতরাং সমগ্ৰ ব্রম্ভান্ডই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এর বিষয়।বাস্তবিকপক্ষে সভ্যতার আদি যুগ থেকেই মানুষ প্রাকৃতিক চর্চা করে এসেছে। বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে সুদূর অতীতে ও মানুষ সর্বপ্রথম যে সমস্ত বিষয় নিয়ে চর্চা করেছে তার মধ্যে গ্রহ-নক্ষত্র ও সৌরজগৎ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়ে রেখেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান একটি আদি বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত । আবার মানুষ, এমনকি মানবেতর প্রাণীরাও তাদের চারিপাশের প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পর্কে নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদে সচেতন,শুধু তাই নয় এই সচেতনতা ক্রমে ক্রমে প্রকৃত চর্চায় এবং পরে আরো এক একটি বৈজ্ঞানিক চর্চার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
- সূত্র নির্ণয় - বিজ্ঞানের একটি প্রধান উদ্দেশ্যই হল সূত্র বা তত্ত্ব নির্মাণ করা।যখন এমন একটি নিয়ম লক্ষ করা যায় যা বহুসংখ্যক প্রাকৃতিক ঘটনাকে বর্ণনা,ব্যাখ্যা,নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্ব অনুমান করতে পারে তখনই সেই নিয়মটি ভাষায় প্রকাশ করা হলে তাকে বলা হয় সূত্র।
- পদ্ধতি - বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আহরণ পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট এবং সীমাবদ্ধ। মূল পদ্ধতি পরীহ্মন এবং পর্যবেক্ষণ।পরীক্ষণ পদ্ধতির যথেষ্ট কার্যক্রম নয়। তার একটি নির্দিষ্ট পূর্বনির্ধারিত প্রক্রিয়া আছে। সেই কারণে প্রকৃত পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান নির্ভরযোগ্য হয়।পর্যবেক্ষণ পরীক্ষণের মতো এত নির্দিষ্ট ও নিয়মাবদ্ধ না হলেও তার কার্যক্রম সুপরিকল্পিত।
- পরিমাপ - বিজ্ঞানের আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো পরিমাপ। পরিমাপ করার অর্থ একটি পরিমানকে নির্ভুলভাবে সংখ্যা ও গণিতের ভাষায় প্রকাশ করা। বিজ্ঞানের এই কারণেই পরিমাপ নির্ভর।পরিমাপের যথার্থ ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন বিভিন্ন ভৌত ও প্রাকৃতিক ঘটনাবলির সঠিক ও সুস্পষ্ট সম্পর্ক নির্ণয় করা সম্ভব হয়,তেমনই বিদ্যা হিসাবে বিজ্ঞান ও প্রকৃত মৌলিক করন যোগ্য হয়ে ওঠেছে।
- বৈজ্ঞানিক সত্য - বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রকৃত সত্যকে যুক্তি ও প্রমাণের দৃঢ় ভিত্তির উপর গঠিত। যেহেতু পরীহ্মণ ,যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে ভৌত ও প্রাকৃতিক সত্যতাকে উদঘাটিত হয় সেহেতু সেই সত্যকে অস্বীকার করার কোন উপায় থাকে না ।
- বৈজ্ঞানিক মানসিকতা - বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মানসিকতা তৈরি হয়, যা তাঁর ব্যক্তিত্ব ও আচার-আচরণের অঙ্গীভূত হয়ে যায়।অর্থাৎ এই মানসিকতা শুধুমাত্র বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। জীবনের সর্বক্ষেত্রেকেই প্রভাবিত করে । বিজ্ঞান চর্চার এই আবেদন বিজ্ঞানের প্রকৃতিগত ধর্মের মধ্যেই নিহিত থাকে। সেই কারণে এই বিষয়টিকে বিজ্ঞান প্রাকৃতিক অংশ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
- প্রাচীন যুগ
- মধ্যযুগ
- আধুনিক যুগ
- জ্যোতির্বিদ্যা - প্রাচীন যুগে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করেছে তার মধ্যে গ্রহ-নক্ষত্র ও সৌরজগতের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।জ্যোতির্বিদ্যা একটি আদি বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত। প্রাচীন যুগে বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রধান বিষয় হলো জ্যোতির্বিদ্যা। চীন ও ভারতের আমেরিকা মায়া সভ্যতা জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা ছিল প্রধান ধর্মীয় প্রয়োজন।ভারতবর্ষে গ্রহ-নক্ষত্র গতিবিধি আরো বিশেষভাবে চন্দ্র ও সৌর গতিবিধি, রাশিগুলির অবস্থান ও সঞ্চালন ইত্যাদি নির্ণয় করার জন্য জ্যোতির্বিদ্যায় পাশাপাশি গণিতের বিকাশ ঘটেছিল। ভারতবর্ষ থেকে শূন্যের(০) ধারণা আরবদেশ হয়ে ইউরোপে পৌঁছায়,মায়া সভ্যতা প্রথম ক্যালেন্ডার তৈরি করে। পাশাপাশি চিকিৎসা ভেষজবিদ্যা ও রসায়ন বিদ্যা সম্পর্কিত ধারণা পাওয়া যায়।
- প্রাকৃতিক দর্শন - প্রকৃত বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে যা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে। এই সময় থেকে বিজ্ঞান চর্চা প্রাকৃতিক দর্শন নামে পরিচিত।গ্ৰীসে Thales ৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সূর্যগ্রহণের নির্ভুল অনুমান করতে সক্ষম হয়েছিল। আবার অ্যারিস্টোটল জীববিজ্ঞানী হিসাবে সামুদ্রিক প্রাণীদের যে পর্যবেক্ষণ করেন তার প্রভাব উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রবল ছিল।এরপর ডারউইন পরীক্ষা পদ্ধতির ধারণা বিস্তার করেছিল। অন্যদিকে আর্কিমিডিস ছিলেন অসাধারণ গণিতবিদ। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে টলেমি এবং তারপর রোমের সিসরো বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম অগ্রপথিক। প্রকৃত দর্শনের চর্চার এবং বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস পাওয়া যায় প্লিনি রচিত "প্রাকৃতিক ইতিহাস" গ্রন্থে। চিকিৎসাবিদ্যা ক্ষেত্রেও ভারতবর্ষ আয়ুর্বেদ চর্চা উন্নতি ঘটে। গ্রিসে Hippocrates রোগব্যাধি সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছিলেন তা অনুসরণ করে গ্যালেন শরীর তত্ত্ব নামক বিদ্যার সূচনা করে।